সঠিক কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কাজের শর্ত এবং সম্মিলিতভাবে সংগঠিত ও দর কষাকষির সুযোগের সঙ্গে আবর্তিত হয় শ্রম অধিকার। এই অধিকারগুলো শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের মর্যাদা, সমতা এবং সুরক্ষার প্রতীক। এই প্রতীকের পতাকা বিশ্বের প্রতিটি ভূ-খণ্ডে গেড়ে দেওয়ার জন্যই মে দিবস বা শ্রমিক দিবসের আবির্ভাব। এই দিবসের শিকড়ে রয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের শত শত অর্জন, যেখানে প্রাণ পেয়েছে সংহতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। এই প্রেক্ষাপটে চলুন জেনে নেওয়া যাক আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাস
১৮৫৬ সালের ২১ এপ্রিল ভিক্টোরিয়ায় অস্ট্রেলিয়ান পাথর শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে সম্মিলিতভাবে কাজ বন্ধ রাখে। ঘটনাটি সে সময় একটি বার্ষিক স্মারক হয়ে ওঠে, যা আমেরিকান কর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছিল প্রথমবারের মতো আন্দোলনে যেতে।
১৮৮৬ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ৪ লাখ শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেন। শুরুটা শান্তিপূর্ণভাবে হলেও বিক্ষোভের তৃতীয় দিনে শিকাগোতে কিছুটা সহিংসতা হয়। পুলিশ নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর গুলি চালানোয় বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন। ফলশ্রুতিতে পরের দিন বিক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের জরিমানার অংক বাড়ানো হয়েছে: আইনমন্ত্রী
বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে একটি বোমা ছুঁড়ে মারে। একই সঙ্গে পুলিশের গুলি বর্ষণও চলছিল। এভাবে দুপক্ষের পাল্টা আঘাতে ৭ পুলিশ কর্মকর্তা ও ৪ জন শ্রমিক নিহত হন। বোমাটি ছুঁড়ে মারা মূল ব্যক্তিকে শনাক্ত না করা গেলেও ৮ শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং একজন ১৫ বছরের কারাদণ্ড পান।
দ্য হেমার্কেট অ্যাফেয়ার নামে পরিচিত এই ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক।
হেমার্কেট ঘটনাটি ক্রমেই শ্রমিকদের অধিকারের সংগ্রামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতেই মে মাসের ১ তারিখকে বেছে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে।
১৮৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক জোটের মিলিত সংগঠন সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে। এই সভায় ঠিক হয় ১৮৯০ সালে সেই হেমার্কেট বিক্ষোভের ৪র্থ বার্ষিকীতে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ হবে।
১৮৯০ সালের ১ মে এই আহ্বানের রেশ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশগুলোতে মে দিবসের বিক্ষোভ হয়। অতঃপর ১৮৯১ সালে সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় মে দিবস।
১৮৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের জন্য ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস আইন হয়ে ওঠে। তারপর থেকে সারা বিশ্বে শ্রমিক আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
সেগুলোর মধ্যে সব থেকে তাৎপর্যবহুল ঘটনা ছিল ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গা। এর পাল্টা জবাব দিতে সেকেন্ড ইন্টার্ন্যাশনালের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে দেশের সমস্ত সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল ও ব্যবসায়িক সঙ্ঘগুলো একত্রিত হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় মে মাসের ১ তারিখে ৮-ঘণ্টা দিবসের আইনী প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন হবে। এ সময় প্রতি বছর পহেলা মে’তে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মে দিবস পালিত হবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে: প্রতিমন্ত্রী
বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপন
ভিন্ন ভিন্ন নামের মধ্যে লেবার ডে এবং ওয়ার্কাস ডে- এই দুটি নামই বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া বেশ কিছু দেশে সময়েরও ভিন্নতা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিক দিবস হিসেবে উদযাপন করার অধিকাংশ দেশ পহেলা মে’কেই বেছে নিয়েছে।
চলুন, শুধু মে মাসের ১ তারিখকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনকারী বিভিন্ন মহাদেশের দেশগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
আমেরিকান দেশগুলো হলো:
আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হাইতি, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, উরুগুয়ে এবং ভেনেজুয়েলা।
ইউরোপীয় দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে:
আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রীস, হাঙ্গেরি, ইতালি, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মন্টিনিগ্রো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল রোমানিয়া, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, ইউক্রেন এবং যুক্তরাজ্য।
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে:
আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, মিশর, ঘানা, কেনিয়া, লিবিয়া, মরিশাস, মরক্কো, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, তিউনিসিয়া, উগান্ডা এবং জিম্বাবুয়ে।
এশীয় দেশগুলো হলো:
হংকং, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, বাহরাইন, ইরান, ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং ইয়েমেন।
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক মে দিবস আজ
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, উত্তর মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং স্লোভেনিয়ায় মে মাসের ১ ও ২ তারিখ শ্রমিক দিবস পালিত হয়। আর চীনে উদযাপিত হয় মে মাসের ১, ২ ও ৩ তারিখ টানা ৩ দিন।
এবার চলুন দেখে নেই মে মাস ছাড়াও ভিন্ন তারিখে শ্রমিক দিবস উদযাপনকারী দেশগুলোর তালিকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক দিবস প্রতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার। কানাডার জন্যও একই দিনকে অনুসরণ করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এলাকা, নিউ সাউথ ওয়েল্স এবং দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় মে দিবস পালিত হয় অক্টোবরের প্রথম সোমবার। ভিক্টোরিয়া এবং তাসমানিয়াতে শ্রমিক দিবস মার্চ মাসের দ্বিতীয় সোমবার, তবে নিউজিল্যান্ডে অক্টোবরের চতুর্থ সোমবার।
বাহামাসে ৭ জুন, জ্যামাইকায় ২৩ মে, জাপানে ২৩ নভেম্বর, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগোতে ১৯ জুন, এবং কাজাখাস্তানে সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার পালিত হয় শ্রমিক দিবস।
বাংলাদেশে রানা প্লাজা ভবন ধসে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ২৪ এপ্রিলকে শ্রম নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের শিক্ষা
মে মাসের ১ তারিখ শুধু একটি বার্ষিকী বা দিবস নয়। এটি গোটা বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপন করেছে অধিকার আদায়ের উপাখ্যান। এই আন্দোলনের পরিক্রমায় শিল্পপতি, পেশাদার, শ্রমিক, এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে কতগুলো শিক্ষণীয় বিষয়। চলুন, সেগুলোর স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ করা যাক।
আরও পড়ুন: যে কোনো কারখানায়ই শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা যাবে: আইনমন্ত্রী
শিল্পপতিদের জন্য শিক্ষা
কর্মীদের প্রতি ন্যায্য আচরণ এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সুস্থ ও সন্তুষ্ট শ্রমিকগণ অধিক উৎপাদনশীল এবং কোম্পানির প্রতি অনুগত হয়।
শুধু তাই নয়; পরিবেশগত দায়িত্ব ও নৈতিক ব্যবসায়িক অনুশীলন একটি কোম্পানির সুনাম এবং দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য বৃদ্ধি করতে পারে।
পেশাদারদের জন্য শিক্ষা
পেশাদার নৈতিকতা মালিক পক্ষ ও শ্রমিক শ্রেণী উভয়ের সঙ্গেই পেশাদারদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া এটি কার্যকর ভাবে সমস্যা সমাধানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে পেশাদার ব্যক্তি কেবল আরও দক্ষই হন না, সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তা ও অধীনস্থ শ্রমিকদের নিকট পরম আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। এটি দীর্ঘ মেয়াদে তার ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।
শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা
ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে বড় বড় শক্তিকেও পরাস্ত করা সম্ভব। একত্রিত থাকা শুধু কর্মজীবনেই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সচেতন থাকার জন্য দরকার।
তাছাড়া মে দিবস শ্রমিকদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। ন্যায্য মজুরি, সঠিক কর্মঘণ্টা এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশের ব্যাপারে জানার উপায় তৈরি হয়। এটি শুধু অধিকার আদায়ের জন্যই নয়, ক্রমাগত আত্মন্নোয়ন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যও জরুরি।
আরও পড়ুন: শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে কাজ করব: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা
শ্রমিক দিবসের ইতিহাস বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এক বিস্তৃত মাইলফলক। এই দিনটির তাৎপর্য বোঝা মানেই একে ঘিরে আন্দোলনের ত্যাগ ও যাবতীয় অর্জনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা।
সেই সঙ্গে আসে সর্বদা সক্রিয় ও সজাগ থাকার শিক্ষা। এর ফলে মেধা ও মননের মাধ্যমে শ্রম অধিকার সম্পর্কে মালিক শ্রেণী বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থাকে তারা দায়বদ্ধ রাখতে পারে।
শেষাংশ
ভিন্ন নাম বা ভিন্ন তারিখে হলেও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মুল উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। প্রতিটি স্লোগানের মূল কথা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় এবং সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। আন্দোলন মুখর ঐতিহাসিক প্রতিটি ঘটনা শিল্পপতি ও পেশাদারদের বারবার সতর্ক করে শ্রম আইন ও তার সঠিক চর্চার ব্যাপারে। হাজারও আত্মত্যাগের স্তম্ভে গত এক শতাব্দি ধরে যে সংগ্রামী স্থাপনা গড়েছে, তা বর্তমান সময়ের শ্রমিকদের পথ চলার পাথেয়। যে মাইলফলক ধরে অবলীলায় সামনে এগিয়ে যেতে পারে এ যুগের তরুণ প্রজন্ম। গড়ে তুলতে পারে শ্রমজীবীদের জন্য শর্তহীন সাম্যের পৃথিবী।